নিউজ ডেস্ক : সবল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই ধারাবাহিকতায় এবার একীভূত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৬ ব্যাংক। উক্ত ব্যাংকগুলো হলো সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, বিডিবিএল ও অগ্রণী ব্যাংক। এরই মধ্যে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে উচ্চ খেলাপি ঋণের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) দ্রুতসময়ের মধ্যে একীভূত করার বিষয়ে আলোচনা শেষ হয়েছে।
বুধবার (৩ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে আলাদা সভা করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
এদিকে, বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) ব্যাংক একীভূতকরণ (মার্জার) বিষয়ে একটি নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতিমালা অনুযায়ী সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-বিডিবিএল, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক- এই ৬ ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-বিডিবিএল, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক-রাকাব অচিরেই একীভূত হবে বলে গভর্নরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর এমডিদের আলাদা সভায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই অনুসারে সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। আর তা না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজ উদ্যোগে এসব ব্যাংক একীভূত করবে বলে সভায় উপস্থিত সূত্র জানিয়েছে।
এর আগে বেসরকারি খাতের শরিয়াভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে নাজুক পদ্মা ব্যাংক একীভূত হওয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এ দুই ব্যাংকের আদলেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দ্রুতসময়ে চার ব্যাংক সমঝোতা স্মারক সই হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি অ্যাডভাইজর ও সদ্য বিদায়ী ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের এবং সরকারি চার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। আনুষ্ঠানিকতার জন্য এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, রাষ্ট্রীয় বেসিক ব্যাংকও একীভূত হচ্ছে। ব্যাংকটি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে বেসিককে এক করা হতে পারে। সরকারি ৬ ব্যাংক ও পদ্মা ছাড়াও বেসরকারি আরও আটটি ব্যাংক একীভূতকরণের আলোচনা রয়েছে। এভাবে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে ৬১ থেকে ৫০ বা এর নিচে নামানো হবে।
আমানতকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের দায় ও সম্পদ মিলিয়ে দেওয়া হবে। ভালো ব্যাংক যেন চাপে না পড়ে, সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন বিষয়ে নীতি-সহায়তা দেবে। এতে খারাপ ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) এবং বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণে (এসএলআর) ছাড় দিতে পারে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের বিপরীতে সাধারণভাবে যে হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয় সেখানেও শিথিল করা হবে। ভালো ব্যাংকে এসে গ্রাহকের যেন আমানত ফেরত নেওয়ার চাপ তৈরি না হয়, সে জন্যও একটি ব্যবস্থা রাখা হবে।
অন্যদিকে, একীভূত হওয়া ব্যাংকের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকের পরিচালক আগামী ৫ বছর অন্য কোনো ব্যাংকে পরিচালক হতে পারবেন না। একই সঙ্গে চাকরি হারাবেন দুর্বল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি)।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে দুর্বল (খারাপ অবস্থা) থাকা ব্যাংকগুলো নিজ থেকে একীভূত না হলে বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত করা হবে। এর আগে দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা সই করতে হবে। এরপর আমানতকারী, পাওনাদার ও বিনিয়োগকারীর অর্থ ফেরতের পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক চিত্র বের করবে। সর্বশেষ আদালতের কাছে একীভূতকরণের আবেদন করতে হবে ব্যাংকে।
এতে কোনো ব্যাংক মূলধন ও তারল্য ঘাটতি, খেলাপি ঋণ, সুশাসনের ঘাটতি এবং আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপের কারণে পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কের আওতাভুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক পুনরুদ্ধারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিনিষেধ মানতে হবে। পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে আমানতকারীর স্বার্থে ব্যাংক বাধ্যতামূলক একীভূতকরণ হবে। একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শৃঙ্খল এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার লক্ষ্যে ব্যাংকের অনুসরণের এ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
একীভূতকরণের পদ্ধতি:-
দুই বা তার অধিক ব্যাংক বা ক্ষেত্রমতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি একীভূত হওয়ার বিষয়ে একমত হয়, তবে ওই ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ পর্ষদে বিষয়টি উপস্থাপন করে নীতিগত অনুমোদন গ্রহণ করবে। এরপর তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে তালিকাভুক্ত হলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কাছ থেকে অনুমোদন নেবে। এরপর হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংক এবং হস্তান্তরকারী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার বা যে অংশ অধিগ্রহণ করা হবে তার নিরীক্ষা, আর্থিক এবং আইনি কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তার তালিকাভুক্ত নিরীক্ষা ফার্ম থেকে এক বা একাধিক নিরীক্ষা ফার্মকে নিয়োগ দেবে।
এক্ষেত্রে ওই নিরীক্ষা এবং আর্থিক ও আইনি কাজ সম্পন্ন করার খরচ বহন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারী, পাওনাদার ও শেয়ারহোল্ডারদের দাবি পরিশোধসহ সম্পূর্ণ একত্রীকরণ কার্যক্রম সুষ্ঠু ও যথাযথভাবে সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষা ফার্ম তার নিরীক্ষা এবং আর্থিক ও আইনি কার্যক্রম প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট দাখিল করবে। এসব বিষয় সম্পাদনকালে তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। এতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রদত্ত অনুমোদন বাতিল করতে পারবে।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা হলে ওই প্রতিবেদন গ্রহীতা ও হস্তান্তরকারী কোম্পানিকে দেওয়া হবে। এরপর তারা নিজ নিজ পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করে অনুমোদন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। শেয়ারহোল্ডার বা পাওনাদারদের সম্মতির জন্য বিশেষ সভা আহ্বান করে বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে পাওনাদার বা শেয়ারহোল্ডার অথবা সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতি গ্রহণ করতে হবে। একত্রীকরণ সংক্রান্ত স্কীম বিশেষ সাধারণ সভায় অনুমোদনের পর হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতির জন্য আবেদন করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সন্তুষ্টির পর এটি কার্যকর করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের নিকট অনুমোদনের জন্য আবেদন দাখিল করবে।
হাইকোর্ট অনুমোদনের বিষয়ে অনাপত্তি দিলে হস্তান্তর গ্রহীতা ও হস্তান্তরকারী কোম্পানি জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিস্ট্রারের নিকট নিবন্ধন করার জন্য হাইকোর্টের আদেশের কপি দাখিল করবে। সে অনুযায়ী, স্কীমটি বাস্তবায়নের জন্য শেয়ারহোল্ডাররা ও অন্যান্য অংশীদারগণের অবগতির জন্য নোটিশ প্রদানপূর্বক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং স্কিমের একটি কপি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নিকট প্রেরণ করবে। এসব বিধান অনুসরণ করে দুইটি প্রতিষ্ঠান একীভূত হবে।
এসএনআর/নিউজ ডেস্ক/তিতাস টাইমস২৪






0 মন্তব্যসমূহ